ঢাকাশনিবার , ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ছোট গল্প: পাউডারের ঘ্রাণ

প্রতিবেদক
admin
ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৫ ১২:০৩ অপরাহ্ণ

বর্তমানে ঢাকায় বসবাস করছি। ১৯৮৭ সালে বরিশালের চাখার থেকে ঢাকার ফকিরাপুলে এসে উঠি বন্ধু কামরুজ্জামানের মেস মেম্বার হয়ে। এর পর ঢাবির অধীনে থেকে শুধু এম. এস. এস. সম্পন্ন করি অর্থনীতি বিষয়। তখন নানা চড়াই-উৎড়ায়ে ও কষ্টে সাংবাদিকতা শুরু এবং এখনও। তখন বাংলা (বিজয়) কম্পিউটারে প্রশিক্ষণ নেই আরামবাগে অবস্থিত মোস্তফা জব্বার সাহেবের আনন্দ কম্পিউটারে। কম্পিউটার শেখার কারণে সংবাপত্রে কাজ নেয়া আমার সহজ হয়। কারণ তখন সাংবাদিকরা কেউই কম্পিউটার জানতেন না। তাদের নিউজ কম্পোজ করতেন অপারেটরেরা। সেখানে আমি আমার নিউজ নিজেই কম্পোজ করে দিতাম। যাক সে কথা।

এরপর বিয়ে, সংসার, স্ত্রী-সন্তান মানুষের যা হওয়ার তাই। গ্রামের বাড়ি বরিশালের চাখারে। চাকরির সুবাধে বছরে শুধু ঈদের সময় একবার বেড়াতে যেতে পারতাম। তা ছাড়া যাওয়া সম্ভব হতো না। পদ্মা সেতুর আগ পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলবাসীর একমাত্র আরামের বাহন ছিলো লঞ্চ। আমরাও লঞ্চে যাওয়া-আসা করি। যেতে ভালো লাগে ও কমফোর্ট মনে হয়। ঈদ আসলেই গ্রামের বাড়িতে যাবো তাই মা-বাবা মুখিয়ে থাকতেন কখন বাড়িতে আসবো। ঘটনাটি ১৯৯৭ সালের দিকের। ঐ সময় সদর ঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়ে আসতো পিরোজপুরের হুলারহাট হয়ে বাগেরহাট পর্যন্ত। আমাদের লঞ্চঘাট হলো চাখারের লষ্করপুর, ডাক্তারের হাট ও হক সাহেবের হাট। তিনটির যে কোন এক ঘাটে নামলেই হতো। তখন সদরঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়তো বিকেল ৩টার পর। আমাদের বাড়ির ঘাটে লঞ্চ এসে পৌঁছতো রাত ৪ টার দিকে। তখন তো গ্রামে বিদ্যুৎ ছিলো না, রাস্তাঘাট ছিলো কাঁচা। লঞ্চঘাট থেকে আমাদের গ্রামের বাড়ি সোনাহার যেতে ২০ মিনিটের পথ। আমার ছোট ভাইয়েরা রাত ৩টার দিকে হ্যারিকেন নিয়ে এসে বসে থাকতো লঞ্চের অপেক্ষায়। কনকনে শীতের রাতে তারা জবুথবু অবস্থায় সন্ধ্যানদীর পুবদিকে দৃষ্টি দিয়ে থাকতো, কখন লঞ্চ আসে! এসময় লঞ্চের যাত্রীদের নিয়ে যাওয়ার জন্য এলাকার ভ্যান ও রিকশা অপেক্ষা করত। রাত ৪টার পরে এমভি নাবিক লষ্করপুর লঞ্চঘাটে থামলো। প্রচÐ শীত। মনে হচ্ছিল শীতের বৃষ্টি, সহ্য করা যাচ্ছিলো না। তখন আমার মেয়ের বয়স সম্ভবত দুই বছর। বাড়ি থেকে যারা আমাদের নিতে এসেছে তাদের গায়ে চাঁদর, মাফলার ও সঙ্গে কাঁথা। এখনকার মতো তখন কম্বল ছিলো না। আমরা লঞ্চ থেকে নেমে শীতের মধ্যে পড়েছি। কি করার মেয়ে ছোট্ট। তাকে তোয়ালে ও বিছানার চাঁদর দিয়ে তার মা বাঁধার পর, আমরা বাড়ির দিকে রওয়ানা হই। আর আমি গায়ে দিলাম ভাইয়ের আনা কাঁথা। এভাবে কেউ না কেউ নিতে আসতো প্রতি ঈদে। সেসব স্মৃতি এখনও হাতড়িয়ে বেড়াই। ঐ রাতটি ফেরত পেতে চাই আবারো?

মা তো জানতেন আমরা আসবো। তাই খাটে মশারি ও বিছানা গুছিয়ে রাখতেন মা। যাতে করে আমরা এসেই ঘুমাতে পারি। তখন গাঁয়ের মানুষ কাঁথাই বেশি ব্যবহার করতো। লেপের সংখ্যা কম। গ্রামের মানুষ কাঁথা, লেপ, বালিশ ও বিছানার চাঁদর গরমের সিজনে ট্রাংকে (বড় টিনের তৈরি সুটকেস) রাখতো, আর শীতের সিজনে তা বের করতো। আমি ঈদের আগের দিন রাতে আসবো, তাই মা অপেক্ষায় থাকতো ও নামাজ পড়তো। ঐ সময় ঘরে একটি মাত্র খাট ছিলো, অন্যগুলো চকি। নানার দেয়া খাটটিই আমার জন্য বরাদ্দ করে রাখতেন মা। ভোর রাতে এসে মার সাথে কুশল বিনিময় করে ঘুমাতে মশারির মধ্যে ঢুকে যাই। অনেক অনেক শীত। অন্যদিকে আসছি সারারাত জার্নি শরীর ক্লান্ত। কাঁথা ও লেপের মধ্যে একেবারে ঢুকে গেলাম। যখন লেপ গায়ে দিলাম সুন্দর গন্ধ বের হলো। কিছু না ভেবেই ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে মা ডাকলো উঠো উঠো নাস্তা খাবে না? আমরা আড়মোড় দিয়ে উঠলাম, কন্যাটি উঠলো না। নাস্তা শেষ করে মাকে জিজ্ঞেস করলাম। মা তোমার বিছানা থেকে এতো ঘ্রাণ আসে কিসের? মা হেঁসে দিলো, কিছুই বলছেন না! আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম, কি বলো না? মা বললো, বাবা! বিছানাপত্র তো সব ট্রাংকের মধ্যে থাকে।

এক বছর পর বের করলাম। বিছানাপত্রে যদি গন্ধ পাও তাই ঘরে থাকা পাউডার কাঁথা ও লেপে মেখে দিয়েছি। তুমি তো শহরে থাকো এখন তো আর এসব বিছানায় ঘুমাতে পারবে না? মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে থাকছি! শুধু বলছি, এসব বিছানায় ঘুমাতে এখনো পারি, সারাজীবন পারবো। আর কোন মন্তব্য করতে পারছিলাম না। মায়ের ভালোবাসার জন্য তখন চোখে পানি আসছিলো। ইতোমধ্যে বাবা ডেকে বললো, নামাজ পড়তে যাবে জোগার হও। হুজুর নামাজের পর পর এসে গরু কোরবানী করবেন। আমার মা-বাবা এখন আর দুনিয়ায় নাই। মা চলে গেছেন ২০১৩ সালে আর বাবা ২০১৯ সালে। আজো মা’র সেই অভিনব পদ্ধতির কথাগুলো আমার মস্তিষ্কে সেভ হয়ে রয়েছে। আজো সেই পাউডারের কথা মনে হলেই চোখের কোনা কেমন জানি স্যাঁত স্যাঁতে হয় যায়।
মা এরকম অভিনব ঘটনা যে কত ঘটিয়েছেন তার হিসাব নাই। তার কথা মনে হলে ভালো লাগে না। আমার মনে হয় পৃথিবীর সব মায়েরা এরকমই হন। মা যখন জীবিত ছিলো তখন বিষয়গুলো নিয়ে এমন করে ভাবতাম না। মা-বাবা এখন আমাদের বাড়ির দক্ষিণে নির্জন জঙ্গলে সুনসান নীরবতায় শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন। মাকে বলতে ইচ্ছে করে, মা এখনো বাড়িতে আসলে তোমার দেয়া পাউডারের ঘ্রাণ পাই। তোমার পাশে এলে বিছানায় পাউডার মেখে রাখবে তো? আসছে ভালোবাসা দিবেসে মায়ের ঐ পাউডার সবাইকে উপহার দিলাম।-মমর

সর্বশেষ - জাতীয়