পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার প্রচেষ্টা সকলের। তাইতো এক সাথে চলার পরিকল্পনা নিয়ে জাতিসংঘ পরিবেশ রক্ষায় সংগঠিত হয়ে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে। যা রূপ দেয় ইউএনইপি নামে। ইউএনইপি পরিবেশ রক্ষার পৃথিবীব্যাপী শীর্ষ কর্তৃপক্ষ। তাদের মূল লক্ষ্য হলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সাথে আপোষ না করে দেশ ও জনগণকে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে অনুপ্রাণিত করা, অবহিত করা এবং সক্ষম করে গড়ে তোলা। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত UNEP, পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার জন্য সরকার, সুশীল সমাজ, বেসরকারি খাত এবং জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সাথে কাজ করে চলেছে গত ৫৩ বছর। ওজোন স্তর পুনরুদ্ধার থেকে শুরু করে বিশ্বের সমুদ্র রক্ষা এবং একটি সবুজ, অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির প্রচেষ্টায় তারা সচেষ্ট সর্বদা। সংস্থাটি জলবায়ূ পরিবর্তন, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্রের ক্ষতি এবং দূষণের ত্রিপল গ্রহ সংকটের মূল কারণগুলোর উপর ড্রিলিং করে রূপান্তরমূলক পরিবর্তন চালাচ্ছে। সংস্থাটি ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রকে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন এবং প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপন করতে সহায়তা করে। পৃথিবীকেবাংলাদেশের সংবিধান ১৮-ক তে বলা আছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবে। এসব নিয়ম, আইন, তদারকী সংস্থা সবই দেশ-বিদেশে রয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কাথা। এগুলো সঠিকভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে না বলেই গোটা পৃথিবী এখন পরিবেশ রক্ষায় জোড়ালোভাবে তদারকি দিচ্ছে। বর্তমান পৃথিবী পরিবেশ দুষণের কবলে পরছে মারাত্মকভাবে। বাংলাদেশ এ থেকে রেহাই পাচ্ছেনা। রেহাই নেই তৃতীয় বিশে^র অন্যান্য দেশগুলোও। পৃথিবীর পরিবেশের দিকে তাকালে যে চিত্র দেখা যায় তার চেয়ে শতেক ভাগ খারাপ চিত্র দেখা যায় বাংলাদেশে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু সরকারের ওপর ভরসা করে থাকলে চলবে না, যার যার দায়িত্ব যতোটুকু সেগুলো বাস্তাবায়ন করা ছাড়া আর কোন গত্যান্তর নেই আমাদের।
প্রতিবেদক সরেজমিনে জানেন-দেশের বন উজাড়, ইটভাটা, নদী ভরাট, নদী শাসন, পলিথিন, দুষিত পদার্থ, ইলেক্ট্রিক বর্জ্য, কারখানার বর্জ্য, ঘনবসতি, বহুতল ভবন, এলুমিনিয়ম, প্লাস্টিক পণ্য, কাঁচ, ফাইবার, ধাতব বস্তু, পানি দূষণ, বায়ু দূষণ, মাটি দূষণ, শব্দ দূষণ, চারদিকে দূষণ আর দূষণ। গোট দেশ এখন দুষণে ভরপুর।
বাংলাদেশ একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত বাসস্থান। দেশের ৬৪ জেলায় রয়েছে ছিন্নমূল পরিবার। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রোহিঙ্গারা রয়েছে অপরিকল্পিত বাসস্থানে। আর শহরের বস্তির অবস্থাতো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অন্যদিকে বাসস্থানের কারণেই প্রতিদিনই নষ্ট হচ্ছে শত শত হেক্টর কৃষিজমি। আবাসন ও ইট ভাটার জন্য আবাদি মাটি কমছে। দেশে বহুতল ভবন নির্মাণে কংক্রিট, এলুমিনিয়াম সীট, প্লাস্টিক, কাঁচ, ফাইবার, স্টীল ইত্যাদি ধাতব বস্তুর ব্যবহার হলেও স্বল্পোন্নত দেশে প্রধানত ইটের ব্যবহার হয় বেশি। আর ইটে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার উপাদান মাটি ও বৃক্ষসমূহ। ইট তৈরিতে নষ্ট হচ্ছে শত শত একর ফসলি জমি-মাটি ও প্রকৃতির মূল্যবান গাছগাছালি। ইট পোড়ানোর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ আর পরিবেশ দূষণের কারণে দেখা দেয় শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত জঠিলতাসহ মানুষের স্বাস্থ্যগত সমস্যা। নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র, কৃষিজমি, উর্বর মাটি ও বায়ু। পরিবেশ অধিদপ্তর এসব নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জমি যেভাবে তার উৎপাদন ক্ষমতা হারাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৪০ সালের মধ্যে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ খাদ্য ঘাটতির মুখোমুখি হবে। এছাড়া কার্বনডাইঅক্সাইড গ্যাসে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে অসময়ে বন্যা, আকস্মিক ভারী বৃষ্টি এবং খড়ার কবলে পরবে দেশ। সালফার এবং নাইট্রোজেনের অক্সাইডসমূহ এসিড বৃষ্টির জন্য দায়ী। এর ফলে ফসল ও মাছের ক্ষতি হচ্ছে মারাত্মকভাবে। পাখিসহ জলচর ও উভচর প্রাণীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে। দেখা গেছে রাজধানীর তুরাগ, বসিলা, মিরপুর, কেরানীগঞ্জ, আশুলিয়া, আমিনবাজার, মিরপুর বেড়িবাঁধ, বালু নদী, ফতুল্লা, শ্যামপুর, পাগলা, শীতলক্ষ্যা, ইছামতি, বংশী, ধলেশ^র ও বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর ক্ষতিকর পরিবেশের প্রভাব পরছে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা ক্রমশ বাড়ছে। বর্তমানে প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্র দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইউএনইপি থেকে ‘বিশ্বের প্লাস্টিকের ব্যবহার পরিস্থিতি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয় এই প্লাস্টিক বর্জ্য পদার্থ সমুদ্রের সৌন্দর্য্য নষ্টের পাশাপাশি সমুদ্রের পরিবেশ ক্ষতিসাধন করছে। কলকারখানা সাধারণত নদী কিংবা খালের আশেপাশে তৈরি করায় তার বর্জ্যে পানি দুষিত হচ্ছে অহরহ। কারখানা ও জাহাজের বর্জ্য যেমন-পারদ, সীসা, ক্যামিক্যাল ইত্যাদি সমুদ্রে থাকা জলজ প্রাণীর দেহে প্রবেশ করায় তাদের দেহে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলার হাটবাজারগুলো ও শপিংমলে দেখা যাচেছ দেদাড়ছে ব্যবহার হচ্ছে পলিথিনের ব্যাগ। পলিথিন ব্যবহার রোধে সরকারের উদ্যোগও তেমন নয়। এ থেকে রেহাই পাচ্ছে না গোটাদেশের পরিবেশ। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকার গাছগুলো নিধন হচ্ছে। পাহাড় কেটে সমতল করা হচ্ছে, চাষ করা হচ্ছে তামাকসহ নানা মাদকজাত ফসল। পাহাড় কাটাই হলো পরিবেশ বিপর্যয়ে অন্যতম একটি কারণ। সম্প্রতি বান্দরবন, কক্সবাজার, কুয়াকাটা, পদ্মা, মেঘনা, বুড়িগঙ্গা, কীর্তনখোলা, সন্ধ্যা, ধলেশ^রী, মধুমতি, বলেশ^র, কাপ্তাই, সুরমা, হাওড়া-বাওড়গুলোতে দেখা গেছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নানা দৃশ্য। তিস্তাব্যারেজ পানি শূন্য হলে তিস্তা নদীর অববাহিকা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাটের নি¤œাঞ্চল ও চরাঞ্চল কখনো প্লাবিত কখনো শুকিয়ে যায়। এর ফলেও এসব জেলায় প্রকৃতিক পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়। হয় না কোন ফসল।
২০২৫ সালে এসে দেখছি বিভিন্ন প্রাণীসহ মানুষ প্রকৃতির রোষাণলে পড়ছে। আমরা যদি আমাদের পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেতন না হই, তাহলে এ ভূমিকে টিকাতে পারব না। আমাদের অসচেতনতা ও হেয়ালীপনার কারণে আমারাই ধ্বংস হচ্ছি। ধ্বংস করছি পরবর্তী প্রজন্মকে। পরিবেশ রক্ষায় সকলকে কাজ করতে হবে। জীবনধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার ও নিয়ম মেনে চলতে হবে। প্রকৃতি আজ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশকে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখতে সঠিক উদ্যোগের কোন বিকল্প নেই। নিজেকে ভালো রাখার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে মিতালি করি, পরিবেশকে দেই সুরক্ষা।
লেখক: (MMR) সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক ও সংগঠক।