দেশে সংগ্রাম চলছে, সেই সময় মুক্তিযুদ্ধকে সংগ্রাম বলতো। ঐ সংগ্রামের সময় অর্থাৎ ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে একদিন মা আমাকে বললেন, তোমার মামাবাড়ি উজিরপুর উপজেলার হানুয়া গ্রামে যাও। তাদের সাথে দেখা করে আসো। সে গ্রামে নাকি মিলিটারি আসছিলো। আমি মায়ের কথায় রাজি হয়ে একদিন মামাবাড়ি বেড়াতে যাই। তখন আমার নানা ইয়াসিন মৃধা জীবিত ছিলেন না। তবে নানিজান সাহিদা বেগম আল্লাহর রহমতে বেঁচে ছিলেন। আমি যাওয়ার পর নানিজান খুব খুশি হলেন এবং আমার কাছ থেকে আমাদের বাড়ির নানা খোঁজ-খবর জানলেন।
নানিজান আমাদের খুব ভালোবাসতেন, কারণ আমার মা তার বড় সন্তান। নাতি-নাতনি বলতে আমরাই। আমার মামা-খালা সবাই মোটামুটি বড়। তারা স্কুল ও কলেজগামী ছাত্রছাত্রী। মামা-খালারা পাঁচ ভাই আর দুই বোন। আমার মা যোবাইদা বেগম সকলের বড়। দেশে যে সংগ্রাম চলছে তা নিয়ে নানিজান আমাকে নানা কথা বলছেন। তিনি বলেন, তোমার মামা মো. নূরুল হক মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার জন্য বাড়ি ছেড়ে ভারতে চলে গেছে। তাকে নিয়ে আমার যতো চিন্তা। আমার কথা শুনলো না, সংগ্রামে যোগ দিবে, মুক্তিযোদ্ধা হবে। নানীজান বলছেন, দেশ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা গেলেই বাঁচতাম, নূরু তো ফিরে আসতো। মামা বাড়িতে গিয়ে দেখলাম এক ঘটনা। তাদের বাড়ি কাছারি ঘর রয়েছে। আগেকার সময় বাড়িতে বড় ঘর থাকা অবস্থায় একটা ছোট আকারের ঘর থাকত, তাকে বাহিরের ঘর বা কাছারি ঘর বলা হতো। সেখানে দেখি অনেক লোক। তারা চুপচাপ থাকছেন। কাউকে কাউকে টয়লেটে ও গোসল করতে পুকুরঘাটে যেতে দেখি। তাছাড়া কেউ তেমন বের হন না।
আমি আমার নওয়া মামা এ কে এম ফজলুল হককে জিজ্ঞেস করি, এরা কারা? তিনি কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে আমাকে বলেন, তারা মুক্তিযোদ্ধা। তারা দেশ স্বাধীন করবে। এলাকায় পাকবাহিনী এলে তারা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। ঐ সময় দেশ স্বাধীন হবে, মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানী বাহিনী এসব তেমন বুঝতাম না। আমি তখন একটু ভয় পেয়ে গেলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের কথা শুনেছি, কিন্তু নিজ চোখে দেখিনি। আজ দেখলাম। তা-ও আমার মামা বাড়িতে। এক ফাঁকে কাছারি ঘরের মধ্যে গিয়ে তাদের যন্ত্রপাতি যেমন রাইফেল, পিস্তল ও হাতবোমা দেখলাম।
এরই মধ্যে চারদিকে দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু হলো। সবাই দৌঁড়াতে লাগল, মামা তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দিলেন না। অন্যদিকে সবাই বলতে লাগলো, পালাও পালাও, মিলিটারি আসছে! আমরা আর কী করব! তাদের সঙ্গে আমরাও দৌঁড়াতে মনস্থির করি। তখন আমার ছোট মামা এ টি এম সিরাজুল হকের সঙ্গে পাশের গ্রাম বানকাঠীর দিকে ছুটতে থাকলাম পালাতে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বানকাঠির এক আম বাগানে গিয়ে পৌঁছলাম। সেখানে গিয়ে ঝোঁপের মধ্যে চুপটি মেরে বসে থাকলাম মামা আর আমি। কাউকে দেখলে ভয় পেতাম। ভাবতাম, এই বুঝি মিলিটারি আসছে বা মিলিটারির সহযোগী রাজাকার-আলবদর আসছে। তখন পাকিস্তানি হানাদারদের সাহায্য করতো দেশের কিছু মানুষ। তাদের বলতো রাজাকার-আলবদর। রাজাকার-আলবদর গ্রামগঞ্জের পথঘাট, মানুষজন ও মুক্তিযোদ্ধাদের খবরা-খবর পাকবাহিনীকে জানিয়ে দিত। সেই রাজাকার আর আলবদর আজ দেশে সবচেয়ে বেশি ঘৃণিত মানুষ। যুদ্ধাপরাধের দায়ে সরকার তাদের অপকর্মের বিচার করেছে। যাক সে কথা।
বানকাঠি গ্রামের বাগানে বসে বসে ভাবছি আমাদের আর রক্ষা নেই। এভাবেই গোটা দিন পার হলো। কী-ভাবে যে দিনটি কাটল তা ভাষায় ব্যক্ত করা যাবে না। ভাবছিলাম, আজ বুঝি আর পাকিস্তানি মিলিটারির হাত থেকে রেহাই নেই। আজ নির্ঘাত গুলি খেতে হবে। না হয় এই হানাদাররা পা দিয়ে পিষে মেরে ফেলবে। পাক বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পেতে মামার শেখানো অনুযায়ী আল্লাহর কাছে দোয়া মোনাজাত করছি সারাদিন। সেদিনকার ভয়ানক ও কষ্টের অভিজ্ঞতা কোনোদিন ভুলতে পারবো না। সারাদিন বসে থেকে বিকেলে মামার সাথে আবার তাদের বাড়িতে আসি। ওই সময় আমার নানার বাড়িতে যে মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন তারাও লুকিয়ে থাকেন। তবে শেষ পর্যন্ত সেদিন মামাদের গ্রামে পাকিস্তানি সেনা আসেনি। হানুয়া গ্রামের সবাই ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে দিনটি পার করেছে। আরো দু’এক দিন পার করে মামাবাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে চলে আসি। তখন আমি একা একাই আসতে পারি। নানিজান আমাকে আসতে দিতে চাননি, তবুও চলে আসি। আমার চলে আসার কারণ হলো-তখন আমি ক্লাস ফোরের ছাত্র। স্কুল বন্ধ, তবে শিক্ষার্থীদের লাইন করে ছাতু দেয়। ছাতু স্কুল থেকে আনতে হবে তাই নানীজানের কথা রাখছিলাম না। আসার সময় নানিজান বলেন, তোমার নূরু মামার কোন খোঁজ পেলে জানাবে। কয়েকদিন পর শুনলাম মামাদের গ্রামে সত্যি সত্যি মিলিটারি ঢুকেছে। অনেক বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, কাউকে কাউকে অত্যাচার, নির্যাতন করেছে। কয়েকজনকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছে। আর এই খবর শোনার পর আমরা কয়েকজন মিলে আবার সেই গ্রামে যাই আগুনে পোড়া বাড়িঘর দেখতে। আগুন দেখে ভিষণ খারাপ লাগছিলো তখন। যেসব বাড়িতে আগুন দিয়েছে সেসব বাড়ির ঘরগুলো পুড়ে ছাই পড়ে আছে। পাক বাহিনীকে জানানো হয় এ মুক্তি আছে।
অন্য এক দিনের ঘটনা। আমরা শুনতে পেলাম, আমাদের বাড়ির পাশের সন্ধ্যা নদী দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের গানবোট যাচ্ছে। আর মেশিনগান দিয়ে গুলি ছুড়ছে নদীর দু’পারের বাসিন্দাদের ওপর। সে কি নির্বিচারে গুলি! ওই ঘটনায় অনেক মানুষ আহত ও নিহত হয়েছিলো। তখনকার সে ঘটনা আমাদের ভাবিয়ে তুলছিলো। আমরা সেদিন সবাই খুব ভয় পেয়ে যাই।
পরের দিন আমরা সব ভাই-বোন মিলে বাগানে গর্ত (বাংকার) খুঁড়ি। যাতে আমরা গুলি আর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের সময় পালিয়ে থাকতে পারি। আমার মনে আছে, অনেক কষ্ট করে ক’দিন খেটে বাগানের মধ্যে গর্তটি খুঁড়ি। পাক বাহিনীর খবর পেলে আমরা সবাই দৌঁড়ে গিয়ে গর্তের মধ্যে পালাতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। আমাদের বাড়িটি ছিলো বরিশাল জেলাধীন বানারীপাড়া থানার চাখার ইউনিয়নের সোনাহার গ্রামে।
সংগ্রামের সময় আমাদের চাখার বাজারে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিলো। আমরা যখন বাজারে যেতাম তখন তাদের সাথে দেখা হতো। তাদের বাজার করতে দেখতাম। তারা অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় ঘোড়াফেরা করতো, সতর্ক অবস্থায় থাকতে দেখতাম। তবে আমরা যারা বাজারে যেতাম তারা ভয়ের মধ্যে থাকতাম। কেউ কেউ উৎসুক হয়ে তাদের দেখতো। এলাকার লোকদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কেউ কথা বলতো না। তাদের ঊর্দু কথা অনেকে বুঝতো আবার অনেকে বুঝতো না। সেনাবাহনীর ক্যাম্প চাখারে থাকলেও তারা কোন অপারেশন বা ক্ষয়ক্ষতি করছিলো না। মুক্তিযুদ্ধের পরে জানতে পারছিলাম, চাখার শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের বাড়ি তাই অত্র এলাকায় পাকবাহিনী অপারেশন থেকে বিরত থাকছিলো। এ সময় আমাদের বাড়ির বাগানে অনেক মানুষ বিশেষ করে হিন্দু লোকজন এসে থাকতো। তাদের আমরা প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা করেছি। তাদের শোনা-গয়না, টাকা পয়সা অনেক সময় আমার বাবা-মার কাছে জমা রাখতো। আমাদের বাগানে তাদের সাথে কথাবার্তা বলতাম, পানিসহ অন্যান্য খাবার দেয়ার চেষ্টা করতাম।
এভাবেই কয়েক মাস চলে গেছে, দেশের অবস্থাও নাজুক। দেশের বিভিন্ন এলাকায় তখন মুক্তিযোদ্ধা ও পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ চলছে। আমরা সেসব খবর জানার জন্য রেডিও শুনতাম। ভাগ্যিস আমার বাবা আলী আহমেদের একটি কাঠের রেডিও সেট ছিল। বাবা এলাকার নেতৃস্থানীয় লোক হওয়ায় দেশ-বিদেশের খবরাখবর শোনার জন্য অনেক আগেই তিনি এটি কিনেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের (সংগ্রাম) খবর শুনতে সেটি এলাকাবাসীর একমাত্র ভরসা ছিলো। সবাই সন্ধ্যা হলে বিবিসি বাংলার খবর শুনতে আসতেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনতেন। বিশেষ করে চরমপত্র অনুষ্ঠানটি সকলের প্রিয় ছিল। দেশের বিভিন্ন এলকায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের কথা শুনে খুব ভালো লাগত। আর ভাবতাম দেশটা কবে স্বাধীন হবে, পাকিস্তানি সেনারা দেশ থেকে কবে চলে যাবে, ইত্যাদি।
দিন গুনতে গুনতে ডিসেম্বর মাস চলে এলো। চারদিকে মুক্তিসেনাদের জয়-জয়কার। সর্বত্রই পাকবাহিনী হেরে যাচ্ছে, রাজাকাররা পালিয়ে থাকছে। এভাবে আরও কয়েকদিন তুমুল যুদ্ধ চলার পর চলে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৭১ সালের সেই ঐতিহাসিক ১৬ ডিসেম্বর; দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। রেডিওতে খবর এলো দেশ স্বাধীন হয়েছে। সবাই এসব কথা বলাবলি করছে; আনন্দ-উল্লাস করছে। আমরা সবার মুখে মুখে এসব সুখবর শুনছি। তখন আমরা শুনেছি, সেদিন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মিটিং হয়, সে মিটিংয়ের পর ওই দিন বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে দেশ স্বাধীন হওয়ার দলিলে সই করে।
৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময় আজ আমরা স্বাধীন দেশের মানুষ। সাড়ে সাত কোটি মানুষের কষ্টের ফলে আমরা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত। এখন ২০২৪ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। ৫৩ বছর গত হলেও আকাশে কালোমেঘের ঘনঘটা বিলীন হয়নি। শকুনিরা পতপত করে উড়ে বেড়াচ্ছে। বাংলা বসন্তের সুবাতাস বইছে না। ১৯০ বছর উপমহাদেশে রাজত্ব করেছে ব্রিটিশ। ২৪ বছর আমাদের শোষণ করেছে পশ্চিমারা। আমরা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছিলাম সেই বাংলাদেশকেই গড়ে তুলবে নতুন প্রজন্ম। আমরা তোমাদের রক্তের ঋণ শোধ করবো ইনশাআল্লাহ। মমর