মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম: আমাদের দেশের রাজনৈতিকদের চরিত্র ধোঁয়াসা। চরিত্র শুধু জীবের থাকে, জড়ো পদার্থের নয়। যেহেতু রাজনৈতিক দল জড় বস্তু নিজে নড়তে চড়তে পারেনা, কিন্তু এই দলকে যারা নাড়াচড়া কড়ায় তারা চরিত্রহীন যেমন মুদ্রার এপিট ওপিট। একসময় বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য আওয়ামী লীগ জামাতের সাথে আতাঁত করে। এখন আবার ফ্যাসিবাদী সরকারকে ক্ষমতা চ্যুত করে দেশত্যাগে বাধ্য করে তাহলে এদের চরিত্রটা কোথায়? ভবিষ্যতে যেকোনো সরকার ক্ষমতায় আসলে তাদের মধ্য থেকে বিরোধী কোন দল যে আওয়ামী লীগের সাথে আতাঁত করে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করবেনা এটার নিশ্চয়তা কোথায়? এইজন্যই রাজনীতিবিদরা জীব আর রাজনৈতিক দলগুলো জড় পদার্থ!আমরা জানি, গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সাদৃশ্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো হলো ক্ষমতা হস্তান্তর না করার মানসিকতা, পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি, দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চার অভাব, স্থানীয় পর্যায়ে ফিউডাল রাজনীতির ব্যাপক অনুশীলন। দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দুটি পরিবারকে কেন্দ্র করে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যেও নির্দিষ্ট দুটি পরিবারের সদস্যদের বাইরে নতুন নেতৃত্ব কল্পনা করার প্রবণতা লক্ষ করা যায় না। বিষয়টি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্রচর্চার প্রক্রিয়া ব্যাহত করে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য একটি লজ্জার বিষয়।
এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যদি কোনো সংসদ সদস্য নিজ দলের বিপক্ষে ভোট প্রদান করে তাহলে তার সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে। সাংবিধানিকভাবে দলকানা হয়ে থাকার অদ্ভুত নিদর্শন শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব।
শেখ মুজিবের আমলে হওয়া এই আইন কোনো রাজনৈতিক দলই পরিবর্তন করেনি। দলীয় কাউন্সিলে সভাপতির পদ নির্দিষ্ট রেখে বাকি পদগুলো নিয়ে কথা হয়। জাতীয়ভাবে এককেন্দ্রিক স্বেচ্ছাচারমূলক নেতৃত্ব চর্চার সংস্কৃতির শুরুটা এখান থেকেই। কোনো সমালোচনা বা ব্যর্থতার দায় নিয়ে দলের অভ্যন্তরে জবাবদিহির অভ্যাস ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়; জাতীয়ভাবে জবাবদিহি তো অনেক দূরের কথা। একজন ব্যক্তির অপকর্মের দায় পুরো দলকে নিতে হয়। ফলে জন্ম নেয় ফ্যাসিবাদ কিংবা স্বৈরাচার। স্বাধীনতার পরে অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে এই গণতন্ত্রহীনতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি এ দেশে বিদ্যমান।
৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখার সুযোগ এসেছে। হাসিনা নানা প্রক্রিয়ায় দেশের মানুষকে বিভক্ত করে রাজনীতি করার প্রয়াস চালিয়েছে। সূত্র কালের কণ্ঠ। কিন্তু জুলাই বিপ্লব বিভক্তি থেকে দেশের মানুষকে গণতন্ত্রের প্রশ্নে এককাতারে আনার অন্যতম উপলক্ষ। সবচেয়ে বড় বিষয়, গোটা প্রজন্মকে রাজনৈতিকভাবে বিকলাঙ্গ করে দেওয়ার পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়েছে। বাংলাদেশে পরবর্তী সময়ে যে রাজনৈতিক সরকার আসবে তাকে অবশ্যই নিজেদের সংস্কারের মধ্য দিয়ে আসতে হবে। দেশের জনগণের মনের কথা শোনার অভিপ্রায় নিয়ে আসতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, তারা শুধু এ দেশের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ; কোনো বিদেশি প্রভুর কাছে নয়। দীর্ঘদিনের আশাহীনতা, আক্ষেপ ও চূড়ান্ত অসহিষ্ণুতা মানুষকে জীবনের তোয়াক্কা না করে রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছিল।
এই বিষয়গুলোর পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। জুলাইয়ের আন্দোলনে এটা প্রমাণিত, এ দেশের মানুষ মরতে ভয় পায় না। যারা মরতে ভয় পায় না, তাদের কখনো গোলামির জিঞ্জির পরানো যাবে না। সাম্য, ইনসাফ ও মানবিক বাংলাদেশের প্রতিজ্ঞা করেই ক্ষমতায় আসতে হবে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের মধ্যে প্রশ্ন করার সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্রীয় অধিকার ও দায়িত্বের প্রশ্নে সর্বদা সচেতন থাকতে হবে। দেশটাকে সবাই মিলে গড়তে হবে। এ দেশ কারো একার না; এ দেশ আমার, আপনার সবার।